রাষ্ট্র বিনির্মাণে কয়েকটি প্রস্তাব (পর্ব-১), নাগরিকত্ব আইনে দ্বৈত নাগরিক হওয়ার সুযোগ এলো কীভাবে? (পর্ব-২)
কালবেলা |
মতামত | উপ-সম্পাদকীয় |
৩০ আগস্ট ২০২৩ পর্ব-১ এবং ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ প্রকাশিত পর্ব-২ একত্রে সংকলিত
রাষ্ট্র বিনির্মাণে কয়েকটি প্রস্তাব
ড. সাজ্জাদ জহির |
বাংলাদেশের চলমান অনৈক্যের সাথে জড়িয়ে আছে দেশ ও জনগণের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিনিময়ের অনুপস্থিতি এবং মত-পার্থক্য মেটানোর স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার অভাব। সর্বোপরি, আঞ্চলিক ও বিশ্বপরিসরের পরাশক্তিদের কাছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্বের নতজানু অবস্থান আমাদের তরুণদের মাঝে তীব্র হীনমন্যতা বোধের জন্ম দিচ্ছে। একইসাথে বিভিন্ন পেশায় শিক্ষিত সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের এক বিশাল অংশ, ধোঁয়াশা দ্বৈত নাগরিকত্বের আশ্রয়ে ভিনদেশের প্রতি আনুগত্যে আবদ্ধ। অথচ, তাদের কেউ কেউ আজ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রাষ্ট্র-নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আগামীতে কারা কোন প্রক্রিয়ায় এই ভূখণ্ডকে শাসন করার ন্যায্য অধিকার পাবেন, সে আলোচনা এখানে করব না। একটি সমৃদ্ধশীল, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়া এবং এখানকার সব নাগরিক যেন সম্মানের সাথে বিশ্বপরিসরে বিচরণ করতে পারে, সেসব অর্জনের জন্য রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। তাই, ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিবেচনার জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা রাখব, যার মাত্র দুটি পৃথক দুই পর্বে উল্লেখ করব।
১। রাষ্ট্রের পরিসীমা– ভৌগোলিক ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক
একটি দেশের ভৌগোলিক পরিসীমা থাকে এবং বাংলাদেশের মানচিত্র, যার সীমানা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃত, তা আজকের ডিজিটাল যুগে অতি সহজেই স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে রাষ্ট্রের পরিসীমা কি কেবলই দেশের ভৌগোলিক পরিসীমার মাঝে আবদ্ধ থাকবে? আরও দুটো ক্ষেত্র রয়েছে— ‘জল ও ভূগর্ভস্থ সম্পদ’ এবং জনগোষ্ঠী, যা ভৌগোলিক সীমানাকে পেরিয়ে যায়। প্রথমটির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাই আলোচনায় তুলছি না। জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব-বলয় সুনির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে নিম্নে কিছু প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব তার নাগরিকের প্রতি, বিশেষত, দেশের ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে অবস্থিত নাগরিকদের প্রতি। তবে, এর কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে নিম্নে উল্লেখ করছি। বাংলাদেশের অনেক নাগরিক বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব যেমন সেখানকার নিয়োগকারী ও সেদেশের সরকার-নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের, তেমনি, সেইসব শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও বিদেশের মাটিতে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়। একইভাবে বাইরে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী অথবা ভ্রমণকারীদের প্রতি সেজাতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে। উপরের দায়িত্বের ব্যতিক্রম ঘটে সেসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যারা ভিনদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছে। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব খারিজের বিষয়ে সাংবিধানিক অস্পষ্টতার আড়ালে এবং কথিত দ্বৈত নাগরিকত্বের বিশৃঙ্খলায় এককালীন উপনিবেশিক দেশগুলো আমাদের মতো দেশগুলোর মেধা, সম্পদ ও কর্মসংস্থান আত্মসাৎ করতে সক্ষম। এবিষয়ে সংবিধানে সংশোধনী জরুরি, যা দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় উত্থাপন করা হয়েছে।
প্রকৃত নাগরিকদের বাইরে জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের দায়িত্বের পরিধি বিস্তৃতভাবে দেখা সম্ভব। নৃ-জাতি, ভাষা ও ধর্মকে ঘিরে আমাদের আত্মপরিচয় বিকশিত হয়েছে, যা নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। পরিচয়ের প্রথম দুটো দিক (নৃ-জাতি ও ভাষা) সমধর্মী, যদিও শংকর হওয়ার কারণে বাঙালিকে ভাষার ওপর বেশি ভর করতে হয়। তবে, ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল, ইরান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ইত্যাদি এলাকা থেকে আসা মানুষের সাথে সংমিশ্রণ ঘটলেও আজ সে অতীত আমাদের বর্ণ ও ধর্মে ছড়িয়ে আছে। একই মন্তব্য সম্ভবত বৈদিক যুগের বাইরে থেকে আসা সংস্কৃত ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভৌগোলিকভাবে, পাশাপাশি জড়িয়ে সহাবস্থান করছে অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃ-জাতি, যাদের থেকে প্রাচীন বাংলা ও বাঙালির ব্যুৎপত্তি ঘটেছিল। উভয় অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই বর্তমানটাই অধিক প্রাসঙ্গিক। সেটাকে বিবেচনায় নিলে, তিনটি জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভেবে দেখা প্রয়োজন, যাদের প্রতিটিই সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করে (ইংরেজিতে যাদের ট্রান্স-বর্ডার কমিউনিটি বলা হয়)। প্রথমটি হলো, ধর্মসূত্রে এখানকার জনগোষ্ঠীর সাথে যারা সম্পর্কিত, অথচ যাদের অনেকের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, বিশেষত, সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যারা বসবাস করেন। তৃতীয় জনগোষ্ঠীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যাদের এক বা একাধিক ধারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বাস করে এবং এদেশেরই নাগরিক। তবে সেসব নৃগোষ্ঠীর অন্য অনেকে সীমান্তের ওপারে বসবাস করে। যদিও এই শেষোক্ত জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা নয়, এটা আজ অনেকের মাঝে স্বীকৃত যে তাদের অনেকের ভাষা মিশ্রিত হয়ে প্রাচীন বাংলার জন্ম দিয়েছিল। এদের মাঝে সাঁওতাল, অহমীয়া (অসমীয়া), মণিপুরি, গারো, হাজং, চাকমা, খাসিয়া, ত্রিপুরী বা করবরক, মারমা, কুকি-চিন-মিজো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত লুসাই, বম, পাংখো ও খুমি এবং আরাকানি (রোহিঙ্গা) উল্লেখযোগ্য।
Read Full Document
(নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব)
ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)
sajjadzohir@gmail.com
(পর্ব-১)
Source: https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/19292
( পর্ব-২)
Source: https://www.kalbela.com/opinion/sub-editorial/23435