সুদহার, মুদ্রা বিনিময় হার এবং মূল্যস্ফীতির বয়ানের পুনর্ভাবনা
বণিক বার্তা |
সম্পাদকীয়, আলোকপাত |
|
ড. সাজ্জাদ জহির |
বাংলাদেশের অর্থনীতি, ক্ষণেকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়িয়েছে এবং সামনের পথটি এখনো স্পষ্ট নয়। সুদের হার, মুদ্রা বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতি ঘিরে যে বয়ানের ভিত্তিতে উচ্চ সুদের হার ধার্যের যৌক্তিকতা দেখানো হয়, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, ক্ষণেকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়িয়েছে এবং সামনের পথটি এখনো স্পষ্ট নয়। সুদের হার, মুদ্রা বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতি ঘিরে যে বয়ানের ভিত্তিতে উচ্চ সুদের হার ধার্যের যৌক্তিকতা দেখানো হয়, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। উচ্চ সুদের হার নিঃসন্দেহে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং মূল্যস্ফীতি কমানোয় তার ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পরিক্রমা নির্ধারণে এসব সামষ্টিক নীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে, যা এড়িয়ে একটি ভিন্ন গতিপথে এগোতে হলে নীতিনির্ধারকদের মানসিকতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
সুদের হার বৃদ্ধির নীতি থেকে ভিত্তিহীন প্রত্যাশা
অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সব সমস্যার সমাধান সুদের হার বাড়ানোয় নিহিত, যা রেপো রেট, আমানত হার কিংবা ঋণের সুদ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এ ধারণার পেছনে সম্ভাব্য যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:
প্রথমত, সুদের হার বাড়লে বর্তমান ভোগের তুলনায় সঞ্চয় অধিক কাম্য হবে। এর ফলে ব্যাংকে জমার বা আমানতের পরিমাণ বাড়বে এবং ব্যক্তির হাতে কম টাকা থাকায় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা কমে যাবে। ফলে সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে একদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্য দুর্বলতা কমবে এবং অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
দ্বিতীয়ত, উচ্চ সুদের হার বিদেশে বসবাসরত অনেককে লাভের উদ্দেশ্যে এখানকার ব্যাংকে আমানত রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে, যার ফলে বেসরকারি রেমিট্যান্স খাতে বিদেশী মুদ্রার সরবরাহ বাড়াবে। সেই সঙ্গে আশা করা হয় যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল হবে, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে ‘স্থিতিশীলতা’ আনবে। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিশ্চিত হলে বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়বে, যা কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে। এ যুক্তির ধারায় কেউ কেউ আশা করেন যে এ পথে এগোলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব!
উল্লিখিত দুটো ধারণায় কিছু ঘাটতি রয়েছে। এটা ভাবা ঠিক নয় যে ব্যক্তির নগদ সঞ্চয় কেবল ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে অথবা ব্যাংকে জমা রাখায় ব্যবহার হতে পারে। সে নগদ অর্থ নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতে পারে, বিশেষত যদি সেই অর্থের উৎস প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অনেকে স্বনিয়োজিত কর্মে নিজ সঞ্চয় বিনিয়োগ করতে পারেন, যা আর্থিক সংকটকালে কর্মসংস্থান ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করবে। এটা অনস্বীকার্য যে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের অনেকে ব্যাংক আমানতের উচ্চ সুদের হারকে আকর্ষণীয় মনে করতে পারে, তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ থেকে অর্থ সরে গেলে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয়, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সহায়ক।
বিদেশী ব্যক্তি খাতের রেমিট্যান্স প্রবাহ সম্পর্কিত দ্বিতীয় দাবি কোনো অংশে কম প্রশ্নবিদ্ধ নয়। এক সময় ছিল যখন বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নাগরিকরা (ফরেন সিটিজেনস অব বাংলাদেশ অরিজিন- এফসিবিও) তাদের বিদেশে অর্জিত আয় ও বাংলাদেশের উৎস থেকে প্রাপ্তি (যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে) উচ্চ সুদের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি আমানত বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ অর্থপ্রবাহ বিপরীতমুখী হয়েছে, যা ব্যাংক প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই করা সম্ভব নয়। স্থানীয় মুদ্রা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায় যে ২০২১-২২ অর্থবছরে সুদের হার কমে যাওয়া, চলতি বছরে (২০২৫) রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং কর-পরবর্তী নিট আয়ের বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ার কারণে এফসিবিওর কাছ থেকে (অর্থ ব্যবস্থায়) বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে রেমিট্যান্স প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই কম। উল্লেখ্য, বর্ণিত এফসিবিওদের প্রবাসী (বা ডায়াসপরা) বলা যায়, তবে তাদের ‘অনিবাসী বাংলাদেশী’, অর্থাৎ এনআরবি (নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশী) বললে ভুল হবে। বরং বললে অত্যুক্তি হবে না যে ‘প্রবাসী’ শব্দের অন্তরালে এফসিবিওরা এনআরবিদের কৃতিত্ব হরণ করতে সচেষ্ট। এ আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখা যায় ব্যক্তি খাতে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আপাত উত্থানের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যাতে। যারা দেশভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহের তথ্য নজরে রাখেন, তারা জানবেন যে বিগত কয়েক বছর ব্যাংক পরিবেশিত তথ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ অধিক পরিমাণে দেখানো হচ্ছে। এ তথ্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে জানতে চাইলে দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার এ রেমিট্যান্স বৃদ্ধির রহস্য উদ্ঘাটন করে বক্তব্য রাখেনি। অথচ আজ সবাই অবগত যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স প্রবাহ গুটিকতক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে নিউইয়র্ক (বা অন্য কোনো মার্কিনি অর্থবাজার) মুখ্য ক্লিয়ারিং হাউজ হিসেবে শক্ত অবস্থানে এসেছে। তাই নানা অ্যাপস ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্রকে প্রেরক দেশ দেখিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে। এসব বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানের অভাব দেখে মনে হয় যে এফসিবিও/প্রবাসীরা আমাদের অনিবাসী কর্মজীবীদের (এনআরবি) কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর মিথ্যা দাবি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট!
মূল্যস্ফীতি হার এবং এর কৌশলগত ব্যবহার
মূল্যস্ফীতি হার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংগঠিত খাতে বেতন বা মজুরি নির্ধারণে জীবনযাত্রার খরচের (COLA) সঙ্গে সমন্বয় রাখতে কর্মজীবীরা সদা সচেষ্ট। সাধারণত ভোক্তা দামের সূচকের (কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই) ভিত্তিতে নির্ণিত মূল্যস্ফীতির (হারের) ওপর নির্ভর করে এ সামঞ্জস্য আনা হয়। মূল্যস্ফীতি ব্যবহারের দ্বিতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো রিয়েল এফেক্টিভ ইন্টারেস্ট রেট (আরইআইআর), যা নামমাত্র সুদের হার থেকে মূল্যস্ফীতি হার বিয়োগ করে বের করা হয়। তাই উচ্চ মাত্রার মূল্যস্ফীতি দেখিয়ে অনেকে আরইআইআর কম বলে দাবি করবেন এবং সেই যুক্তিতে নামমাত্র সুদের হার বৃদ্ধির চাপ দেবেন!
তৃতীয় প্রাসঙ্গিক বিষয় মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে। সাধারণত পাঠ্যপুস্তক বা নিবন্ধে প্রকাশিত এসব দৃষ্টান্তে প্রতিটি স্থানীয় মুদ্রা কিনতে কত ডলার লাগে, সেটাকে বিনিময় হার গণ্য করা হয়। তবে চলতি ব্যবহারের সঙ্গে সংগতি রেখে টাকায় প্রতি ডলারের দাম গণ্য করব।
যদি নামমাত্র বিনিময় হার (নমিন্যাল এক্সচেঞ্জ রেট এনইআর)
e = টাকা/মার্কিন ডলার (এক ইউনিট মার্কিন ডলারের টাকায় বাজার মূল্য), তবে প্রকৃত বিনিময় হার (রিয়েল এক্সচেঞ্জ রেট), RER = e x P/P*, অর্থাৎ নামমাত্র বিনিময় হারকে দুই দেশের মধ্যে মূল্যস্তরের অনুপাতের সঙ্গে গুণ করা হয়, যেখানে P* (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্তর) এবং P (বাংলাদেশের মূল্যস্তর)।
শুরুতে নির্দিষ্ট নামমাত্র বিনিময় হারের (e) পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের আপেক্ষিক দামের স্তর বিবেচনায় এনে প্রকৃত বিনিময় হার (RER) নির্ণয় সম্ভব। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার অধিক হলে প্রকৃত বিনিময় হার কমবে এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে নামমাত্র বিনিময় হার বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি খাড়া করা হবে। অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়ন করা হবে, যা পরবর্তী পর্বের মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে! তাই অবাক হওয়ার নয় যে একটি আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে, নীতি বিভ্রাটের কারণে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমিকভাবে চলতে পারে।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করলে এবং পদ্ধতি বিশেষে অনুমিত মূল্যস্ফীতিতে হেরফের ঘটায়, পদ্ধতি বাছাই নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। ল্যাসপেয়ার ও প্যাশা দাম সূচকের পার্থক্য বিবেচনায় না নিলেও মূল্যস্ফীতির (হার) পরিমাপের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি সাধারণত মাসগুলোকে ‘পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ পরিমাপের একটিতে নির্দিষ্ট কোনো মাসের দাম বিগত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে কী হারে পরিবর্তিত হয়েছে তা নিরূপণ করা হয়। অনিয়মিত দাম ওঠানামা এড়িয়ে মূল্যস্ফীতির মসৃণ সিরিজ পেতে পরিসংখ্যানবিদরা চলমান গড় নিতে পছন্দ করে এবং সেসবের একটি পদ্ধতিতে ১২ মাসের পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মাসিক মূল্যস্ফীতির গড় হিসাব করে সেটি ১২ মাসের শেষ মাসের জন্য মূল্যস্ফীতি হার হিসেবে দেখানো হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত মূল্যস্ফীতি হারগুলো সাধারণত শেষোক্ত পদ্ধতিতে অনুমিত হয়, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিরঞ্জন হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
এটা স্পষ্ট যে সাধারণ দামের স্তর অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি হার বাড়তেও পারে, আবার কমতেও পারে! এছাড়া পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি এবং ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি (যা শেষ মাসে বরাদ্দ করা হয়) একসঙ্গে প্রকাশ করলে সাধারণ মানুষকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা সম্ভব! পূর্বে উল্লেখিত ব্যবহারিক ক্ষেত্র গুনতিতে নিলে লক্ষ করা যাবে যে মূল্যস্ফীতি অধিক গণ্য করা হলে টাকার অবমূল্যায়ন ও অধিক সুদের হার যৌক্তিক মনে হতে পারে। সেই সঙ্গে সংগঠিত খাতে বেতন বা মজুরি অধিক মাত্রায় বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
দ্বৈত অর্থনীতির কাহিনী এবং নীতির পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন
অনেকেই মনে করেন যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষণেকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়িয়েছে এবং এর পরবর্তী গতিপথ স্পষ্ট নয়। ভূরাজনীতির কারণে অথবা কৌশলগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সম্পর্ক হতে পারে। সেসব থেকে বিযুক্ত হয়ে দেখলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিক্রমা একাধিক পথে চলতে পারে। তবে সম্ভাব্য প্রতিটি পথেই রেমিটেন্স নির্ভর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। আমার প্রস্তাবে শুধু বিদেশে কর্মরত অনিবাসী বাংলাদেশীদের (এনআরবি) প্রেরিত অর্থকে রেমিট্যান্স গণ্য করছি না। সে জাতীয় একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে অনুমান করা হচ্ছে যে একটি রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতিতে বিদেশে অথবা দেশে বাংলাদেশীদের সব শ্রমজনিত কার্যক্রম, বাইরের বাজারের জন্য পণ্য বা সেবা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এসব কার্যক্রমের বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে: ক. যারা বাংলাদেশের বাইরে সাময়িক কাজ করেন; খ. দেশে উৎপাদিত পণ্যের রফতানি এবং গ. দেশে বসে সেবার রফতানি। শেষোক্তটি সাধারণত সেবা ইন-সোর্সিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, যাকে উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আউটসোর্সিং বলা হয়।
উল্লিখিত প্রথম ধারার কার্যক্রম রেমিট্যান্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো মুখ্য ভূমিকা রাখে। আগামীতে ছিটমহলরূপী (এনক্লেভ) অর্থনৈতিক অঞ্চলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধরনের কার্যক্রম অধিক মাত্রায় ঘনীভূত হতে পারে এবং সেসব অঞ্চলে এফডিআই অধিকমাত্রায় দেখা যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে দুই স্তরে দ্বৈত অর্থনীতির সহাবস্থানের সম্ভাবনা প্রবল। দুটি ক্ষেত্রেই সংযোগের মাধ্যম একমুখী শ্রমপ্রবাহ। প্রথম ধারায় এদেশ থেকে অন্য দেশে কর্মজীবীরা যাবে, যেমনটি এখন হচ্ছে এবং তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার (রেমিট্যান্স) ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশী-বিদেশী অনেকেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। দেশের অভ্যন্তরে শ্রম করিডোর তৈরি হবে দৈনিক ভিত্তিতে দেয়াল পেরিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রবেশ ও কাজ শেষে বেরিয়ে আসা। শ্রম করিডোর নামক সংযুক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা দ্বৈত অর্থনীতির পরিণতি সব সময় যে শান্তিপূর্ণ সমাধানে শেষ হয় না, তা অন্যান্য দেশের মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে।
রেমিট্যান্স নির্ভর দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকাংশ আয়ের উৎস হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় এবং বাইরের বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার ওপর এসব কার্যক্রমের অস্তিত্ব নির্ভর করে, যা শ্রম, পণ্য ও সেবা—সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে দেশে উৎপাদন কার্যক্রম সংগঠিত হলে স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি তৈরির সম্ভাবনা থাকে। পরিতাপের বিষয় যে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই পুঁজি অক্ষয় রাখা এবং তার সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান হলে এবং সেই রেমিট্যান্স আয়ের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি নিত্যকার সঙ্গী হতে বাধ্য। সেই ব্যবস্থায় উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে মূল্যস্ফীতিতে ইন্ধন জোগায়।
রেমিট্যান্স নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির অন্য পিঠে স্থানীয় সমাজ এমন একটি শ্রমিকের ভাণ্ডারে (রিজার্ভ পুলে) পরিণত হবে, যার সেবাগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে বা অর্থনৈতিক অঞ্চলের এনক্লেভগুলোয় বিক্রি হবে। নিশ্চিতভাবে শ্রমজীবী মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সহায়ক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ থাকবে। তবে বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে দেশের ভেতরকার পণ্য কেনাবেচার কাজটিও হয়তো গ্লোবাল রিটেইলারদের দখলে যাবে।
ওপরের বর্ণনা বিমূর্ত হলেও এ ধরনের অর্থনীতি ধীরে ধীরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে দেখা গেছে এবং মূলধারার থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। গাজাসম পরিণতি এড়াতে এবং দুটি স্তরে দ্বৈত অর্থনীতির জন্য বৈষম্যহীন ভিন্ন কোনো পথ তৈরি করতে হলে নীতিনির্ধারণকারীদের মনোভাবের একটি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন।
সাজ্জাদ জহির, নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
Source: https://bonikbarta.com/editorial/yPMYqyQR7EapPmSo