সম্পদ কর: জানা কথার পুনরাবৃত্তি (প্রথম পর্ব)

বণিক বার্তা |
পর্যালোচনা |
মে ০৩, ২০২৩ |

ড. সাজ্জাদ জহির
|

বেশ কিছুদিন ধরে সম্পদের ওপর কর ও সারচার্জ বা অতিরিক্ত মাশুলের আলোচনায় আমি কিছুটা বিভ্রান্ত। কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার লেখা পড়ে মনে হলো যে নির্দিষ্ট সাংবাদিক সারচার্জকে সম্পদ কর ভেবে সম্পদ কর বাড়ানোর আবেদন করছেন। ২০২২ সালের ইংরেজি-বাংলা বেশ কয়েকটি পত্রিকায় আরো বলা হয় যে আয় ও সম্পদের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এ কর বৃদ্ধি জরুরি। ২০২৩ সালে বাজেট-পূর্ববর্তী মার্চের শেষের পরামর্শ বৈঠকে কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মুখে একই ধারার যুক্তি শুনে নিজের বিচারবুদ্ধি সম্পর্কেই সন্দেহ হতে শুরু করে। সেসব সন্দেহ থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই সম্পদ করের ওপর এ আলোচনা করছি।

আমাদের মতো দেশে ভ্যাট ও মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত জনসাধারণ নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সম্পদ হিসেবে যে সঞ্চয় গড়ে তোলেন, তার ওপর আঘাত এলে মনে সংশয় জাগে। বিশেষত এটা সর্বজনস্বীকৃত যে এ দেশে অতীতের পুঞ্জীভূত সম্পদ বিক্রি থেকে অর্থ যেমন বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, একইভাবে অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থ-সম্পদের বিশাল অংশ ভিনদেশে সম্পদ গড়ে তুলছে। এসবের মধ্যে আমাদের বিজ্ঞজনের চোখে বৈষম্য ও সম্পদের ঋণাত্মক সম্পর্কের ঠুলি বসিয়ে দেয়ায় তারা সম্পদের দেশান্তর ভুলে দেশে গড়ে ওঠা সীমিত সম্পদের ওপর আঘাত হেনে নিজেদের দেশপ্রেম জাহির করতে চাইছেন।

আবেগের বা নিজ অবস্থানের ভালোমন্দ দিকগুলো থেকে দূরে থেকে নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। শুরুতে (এ পর্বে) সম্পদ কর ও সারচার্জের ব্যাখ্যা দেব এবং করনীতি প্রয়োগে মূল্য নির্ধারণের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করব। একমুখী অর্থপ্রবাহের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় দেশীয় পরিসরে আয় ও সম্পদের বৈষম্য দূর করার অজুহাতে সম্পদ কর আরোপের যৌক্তিকতা আছে কিনা, সে আলোচনা করব দ্বিতীয় পর্বে। সবশেষে (তৃতীয় পর্বে) বাংলাদেশে সরকারের কর আদায়ের তাগিদ এবং রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্পত্তি ও সম্পদ করের সম্ভাব্য খাতগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

সম্পদ কর ও সারচার্জ

স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে একজনের মোট সম্পদ হিসাব করা হয়। স্থাবর সম্পত্তিকে দুই ভাগে দেখা হয়, কৃষি ও অকৃষি (অর্থাৎ অকৃষিকাজে ব্যবহৃত জমি, বাসাবাড়ি বা তার জন্য দেয়া আগাম অর্থ)। সম্পদ নির্ণয়ে ব্যবসায় নিয়োজিত অর্থ পৃথকভাবে অন্তর্ভুক্ত, যেখানে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সম্মিলন থাকতে পারে এবং ব্যবহৃত সম্পত্তি অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ী পুঁজি হিসেবে গণ্য করা হয়। অস্থাবর সম্পত্তির কয়েকটি ধরন আছে। প্রথমটি দ্রব্যরূপী অস্থাবর, যেমন স্বর্ণ, মোটর গাড়ি, দামি আসবাবপত্র ইত্যাদি, যা কর রিটার্নসের ফর্মে ভিন্ন ভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এছাড়া রয়েছে আর্থিক সম্পদ, যেমন কোম্পানির শেয়ার, তথাকথিত পুঁজিবাজারে (স্টক মার্কেট) ক্রীত শেয়ারের মূল্য ইত্যাদি। সবশেষে, তরল বা তরলযোগ্য অর্থ, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকে গচ্ছিত সঞ্চয়ী ও চলতি আমানত এবং নিজের কাছে রাখা নগদ অর্থ।

ওপরে উল্লেখিত সব ধরনের সম্পদের পৃথক পৃথক মূল্যায়ন সম্ভব হলে সেসবের যোগফল মোট সম্পদের পরিমাপ হিসেবে গণ্য করা হবে। তার থেকে ঘোষিত দেনা বাদ দিলে নিট সম্পদের মূল্য নির্ণিত হয়। শেষোক্ত পরিমাপের ভিত্তিতে শতাংশ হিসেবে হোক অথবা স্তরভিত্তিক নির্দিষ্ট কর ধার্যের ভিত্তিতে হোক, সম্পদ কর আরোপ সম্ভব। এ জাতীয় করের সঙ্গে নির্দিষ্ট বছরের আয় অথবা আয়করের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ নির্দিষ্ট আয়করের ওপর অতিরিক্ত মাশুল ধার্য করলে তাকে সারচার্জ আখ্যা দেয়া হয়। বাংলাদেশের বিরাজমান আইনে, কারো নিট সম্পদের মূল্য ৩ কোটির অধিক এবং ১০ কোটির কম থাকলে তাকে চিরাচরিত পদ্ধতিতে নিরূপিত আয়করের ওপর অতিরিক্ত (ওই করের) ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। ১০ কোটি টাকার অধিক সম্পদ হলে অধিক হারে সারচার্জ দিতে হয়।

আরো উল্লেখ্য যে সম্পদের বিভিন্ন অংশের ওপর পৃথকভাবে কর আরোপিত হতে পারে, যেমনটি আছে জমির ওপর ভূমি কর, গাড়ির ওপর কর এবং সর্বোপরি বসতবাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের ওপর হোল্ডিং ট্যাক্স। শেষোক্তটি থেকে অর্জিত কর স্থানীয় সরকারের (সিটি করপোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটি) রাজস্বে যায়। এ নিবন্ধে শেষোক্তটিকে সম্পত্তি কর আখ্যা দিয়েছি।

সহজ-সরল বিষয়টি বোঝানোর জন্য এতগুলো কথা বলতে হলো! আমাদের দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন যারা সারচার্জ বৃদ্ধি বোঝাতে গিয়ে সম্পদ কর বৃদ্ধির কথা বলেন। আবার সম্পদ কর বৃদ্ধির প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দেখাতে না পেরে সারচার্জ বৃদ্ধির কথা বলেছেন বলে দাবি করেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে সম্পদের ওপর কর আরোপে ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে জটিলতা থাকার কারণে অপ্রত্যক্ষভাবে সম্পদশালীদের থেকে রাজস্ব আয়ের পথ হিসেবে সারচার্জের প্রবর্তন হয়েছে বলে গণ্য করা যায়।

সম্পদের মূল্য নির্ণয়ের জটিলতা

যারা নিজেরা প্রতি বছর কর জমাপত্র (রিটার্নস) পূরণ করেন এবং সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে পরিচিত তারা জানবেন যে আমাদের হিসাব-পদ্ধতিতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার সময় বা ক্রয়কালে আমাদের সম্পদের যে মূল্য ধরা হয়, তা চিরকালই সেই মূল্যেই রয়ে যায়। কেবল তা বিক্রি করলে মূল্যমানের ও সম্পদের পরিমাণে হেরফের ঘটতে পারে। বর্তমান হিসাব পদ্ধতিতে বিবরণীতে যাবতীয় সম্পদের বছর শুরুর যে মূল্যমান উল্লেখ থাকে, সেসবের মাঝে একটি ব্যতিক্রম শেয়ার পুঁজি। শেয়ারের বাজার দাম ওঠানামা করলে সম্পদের মূল্যমান বাড়ে বা কমে এবং সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট বছরের আয়ে সামঞ্জস্য আনতে হয়! অর্থাৎ,

প্রদর্শিত আয় = অন্যান্য খাতের আয় +(-) শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি (হ্রাস)।

শেয়ারের দাম বাড়লে আর্থিক সম্পদের স্ফীতি ঘটবে এবং শেয়ারের দাম কমলে সম্পদ-মানের সংকোচন ঘটবে।

কর কর্মকর্তারা আমাদের হিসাব নিখুঁতভাবে মেলাতে চান। তাই বছরের শুরুর সম্পদ (মান)+ আয়—ব্যয় = বছরের শেষের সম্পদ (মান)।

উপরোক্ত সাধারণ গাণিতিক বাধ্যবাধকতা থেকে কয়েকটি সূত্র মেলে।

১। যে ব্যক্তি শেয়ারবাজারে অদৃশ্য থেকে অংশগ্রহণ করে, তার সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে রাজস্ব বিভাগের পর্যাপ্ত ধারণা নেই। টিআইএন দেয়া বাধ্যতামূলক না থাকাকালে এ অবস্থা ছিল। বর্তমানে, আমার জানামতে, কোম্পানি বিনিয়োগের আড়ালে থেকে এমন সুযোগ ব্যক্তি করদাতার সীমিত পর্যায়ে থাকতে পারে।

২। যে ব্যক্তি সরকারি বরাদ্দে কম দামে জমি পেয়েছে তার প্রদর্শিত সম্পদমান (ভ্যালু অব ওয়েলথ) কম হবে। অথচ একই পরিমাণ ও মানের সম্পত্তির জন্য, যিনি অধিক দামে বাজার থেকে ক্রয় করেছেন, তার সম্পদমান (রাজস্ব বিভাগের নথিতে) প্রথম ব্যক্তির তুলনায় বেশি হবে।

৩। উপরের দৃষ্টান্তটি আরো খতিয়ে দেখলে জানা যাবে যে রাজস্ব বিভাগের খাতায় যে ব্যক্তিটি অধিক সম্পদশালী, সে আগের আয়ের ওপর অধিক কর দিয়ে তা থেকে সঞ্চয় দেখিয়ে অধিক দামে জমিটি ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছিল। যেসব ক্ষেত্রে কর ফাঁকি দিয়ে গড়ে ওঠা অপ্রদর্শিত আয় ব্যবহার করে কম রেজিস্ট্রি মূল্য দেখিয়ে জমি কেনা হয়, সেসব ক্ষেত্রে কর ফাঁকিবাজরাই রাজস্ব বিভাগের নথিতে তুলনামূলকভাবে কম সম্পদের অধিকারী!

৪। আগে উল্লেখিত সমীকরণে এটাও স্পষ্ট যে আয় অপ্রদর্শিত রাখার সুযোগ থাকলে এবং সেই অর্থ যদি একজন ভিনদেশে পাচার করতে পারে, রাজস্ব বিভাগের নথিতে সেই ব্যক্তি সম্পদহীন রয়ে যেতে পারে! শেষোক্ত বিষয়টি গভীরে ভাবতে গেলে দ্বৈত নাগরিকদের জন্য আমাদের রাজস্ব বিভাগ কী বিধান রেখেছে তা জানা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আগে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (https://www.tbsnews.net/features/panorama/straight-talk-issue-dual-citizenship-605094) প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা করেছি, যা পাঠকরা দেখতে পারেন।

ওপরে উল্লেখিত বাস্তবতার কারণে একই সম্পদের এককপ্রতি দাম যেখানে তুলনাযোগ্য নয়, সেখানে মোট সম্পদমানের ভিত্তিতে কোনো কর প্রবর্তন করলে তাকে ‘‌সততার ওপর কর’ বলে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি হবে না। প্রায় এক যুগ আগে ভিন্ন একটি দৈনিকে (https://www.thedailystar.net/news-detail-184679) বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম এবং অনেকের মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ায় সম্পদ কর প্রবর্তন না করে এ দেশে সারচার্জ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল।

সামাজিক ন্যায়নীতির বিচারে আয়করের সীমাবদ্ধতা লাঘবের উদ্দেশ্যে সম্পদভিত্তিক বাড়তি কর আরোপ নীতিগতভাবে অস্বীকার করা যায় না। তবে সেই আলোচনা ফলপ্রসূ করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন মূল্য-নির্ধারণী পদ্ধতি ও বাস্তবায়নের জন্য বিশেষায়িত দপ্তর, যা অনেক দেশে আয়কর বিভাগ থেকে পৃথক। একই সঙ্গে নিট সম্পদমান নির্ণয়কালে সম্পত্তি কর, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর কর এবং উপহার (গিফট) বা হিবাদানে প্রাপ্ত কর সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। এবং সেসব কার্যকর করতে হলে সহজ পদ্ধতিতে সব সম্পত্তি হস্তান্তর নিবন্ধীকরণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। সরকারি পর্যায়ে এ বিনিয়োগে যাওয়ার (কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার) আগে সরকারি প্রশাসন, সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য খাত, জনসাধারণের নাগরিক অধিকার বলয় এবং ভিনদেশের নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সহাবস্থানের সীমারেখা টানা জরুরি, যা পরের কোনো এক পর্বে আলোচনা করব।

পরিশেষে উল্লেখ করব যে স্থাবর সম্পত্তির অপ্রত্যক্ষ পরিমাপ নিয়ে স্থানীয় কর (যেমন হোল্ডিং ট্যাক্স) নিরূপণের চল বিভিন্ন দেশের সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যে রয়েছে। তবে তার কার্যকর প্রয়োগ স্থানীয় সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং সম্ভবত এ কারণেই জাতীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বিভাগ (এনবিআর) প্রজাদের (নাগরিক) সীমিত সঞ্চয়ে অতিরিক্ত ভাগ বসাতে চাইছে! জনজীবনের উন্নতি আনার জন্য এবং কর সংগ্রহকারী সংস্থার জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পত্তি কর আদায়ের ভার স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকার যৌক্তিকতা রয়েছে। সেই ব্যবস্থায় জাতীয় পর্যায়ের সাম্য নীতি কার্যকর করার সুযোগ রয়েছে। যেমন ধনী এলাকা থেকে দরিদ্র এলাকায় রাজস্ব পুনর্বণ্টন করার জন্য সরকারের মধ্যকার আন্তঃবিভাগীয় ব্যবস্থাপনা সম্ভব এবং সে পথ নেয়াটা অনেক ক্ষেত্রে শ্রেয়। সে ব্যবস্থায় এনবিআর স্বীয় স্বার্থে সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটির রাজস্ব আদায়ের ওপর নজরদারি বাড়াবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে।

[মতামত লেখকের নিজস্ব।]

ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)

Download

 

Source: https://bonikbarta.net/home/news_description/339191/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A6-%E0%A6%95%E0%A6%B0:-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF