শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধির কিছু প্রস্তাব

দৈনিক বণিক বার্তা ।
এপ্রিল ১২, ২০২০ ।

. সাজ্জাদ জহির –

কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রসঙ্গের অবতারণা করছি। কঠোরভাবে বললে, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল—দালান, পাড়া, গ্রাম, শহরের একটি অংশ, পুরো শহর বা একটি দেশ—লকডাউন করার অর্থ নিম্নরূপ:

—প্রাথমিক পর্যায়ে, সেই অঞ্চল থেকে কোনো মানুষ বা দ্রব্য বাইরে যেতে পারবে না। যা কিছুই বেরোবে, তাকে টক্সিক (বিষাক্ত) গণ্য করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তা নির্মূলের ব্যবস্থা নিতে হবে।

—বাইরে থেকে সেই অঞ্চলে উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেবাকর্মী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ। নিয়ন্ত্রিতভাবে সেবা ও খাদ্যসহ অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লকডাউনকৃত অঞ্চলের বাসিন্দাদের পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। কারণ সবাইই জানেন যে সংক্রমণের মাধ্যমেই কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার ঘটে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কথায় যতখানি বুঝি, (১) ভাইরাসটি মুখ, নাক অথবা চোখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসকে রোগাক্রান্ত করে এবং (২) ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুতু এমনকি কথা বলার সময়ে বেরোনো মুখের জলজ পদার্থ, যা (কারো কারো মতে) অনেকক্ষণ বাতাসে ভাসমান থাকতে পারে, সেসবের মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমণ করে। যেহেতু এ রোগের চিকিৎসা আজও আমাদের জানা নেই এবং সংক্রমিত হলে মৃত্যুর হার অনেক বেশি, তাই সংক্রমণ বন্ধ করার মাধ্যমেই আমরা এর বিস্তার রোধ করতে পারি এবং এক পর্যায়ে সমগ্র সমাজকে রোগ ও করোনা-২ ভাইরাস (যা থেকে কভিড-১৯ নামের অসুখটি হয়) থেকে মুক্ত করতে পারব। তাই আবারো উল্লেখ করব, লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু লকডাউনকে কার্যকর করতে হলে কিছু অত্যাবশ্যকীয় করণীয় রয়েছে। যেমন:

—লকডাউনকালীন সরকারকে আটকে পড়া সবার বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে হবে। এলাকা বিশেষে চাহিদা মেটানোর ধরনে এবং দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে হেরফের থাকতে পারে। তবে কেউ নিজ অর্থে অতিরিক্ত কিছু বাইরের বাজার থেকে কিনতে চাইলে সম্ভব হলে তা বাইরে থেকে জোগানের ব্যবস্থা নিতে হবে।

—জরুরি ভিত্তিতে লকডাউনকৃত অঞ্চলের প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তিনটি গোষ্ঠীতে তাদের ভাগ করা এবং প্রাথমিকভাবে অঞ্চলের ভেতরে তিনটি পৃথক অংশে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা। ভাগগুলো হলো: (১) যাদের রোগ ধরা পড়েছে, (২) রোগ ধরা পড়েনি অথচ তার লক্ষণ রয়েছে এবং (৩) যাদের সুস্থ মনে হয়। চিকিৎসকরা আরো সুনির্দিষ্টভাবে অন্যান্য সহযোগী রোগের উপস্থিতিকে গুনতিতে নিয়ে প্রস্তাবিত বিভাজনকে অধিক বিজ্ঞানসম্মত করতে পারবেন।

—যত দ্রুত সম্ভব প্রথম গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করা উচিত। একই সঙ্গে অন্য দুই গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের নিয়মিতভাবে পূর্ব চিহ্নিত স্বাস্থ্যসেবীদের দ্বারা পরিচর্যা করা জরুরি। দুই সপ্তাহে কোনো রোগী চিহ্নিত করা না গেলে বা চিকিৎসকদের মত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পর অঞ্চলটি স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পরিশুদ্ধ করার পরই উন্মুক্ত (আনলক) করা যেতে পারে। উহানকে আনলক করতে সম্ভবত দুই মাসের অধিক লেগেছিল!

উল্লিখিত কাজগুলো কি কেবল স্বাস্থ্যসেবীদের দ্বারা সম্ভব? অথবা যেমনটি কেউ কেউ মনে করেন, লকডাউনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে চাইলে সেনাবাহিনী বা পুলিশের লাঠিপেটা বা হুমকি কি যথেষ্ট? এমনকি আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সেনাবাহিনী নামালেই কি এটা অর্জন সম্ভব? চীনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে অনেক ধরনের কর্মী বাহিনীর অংশগ্রহণ আবশ্যক এবং সেসব কাজে টহল দেয়ার চেয়ে সেনাবাহিনীর মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য বিশেষায়িত পেশার অংশগ্রহণ অনেক বেশি জরুরি।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কমিউনিটি পুলিশ (যেমন, বসুন্ধরায় দেখেছি ও গ্রামাঞ্চলে রয়েছে) ও পুলিশ প্রয়োজন (বা বড় অঞ্চলের জন্য প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা যায়)। তবে সর্বাধিক প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবী ও চিকিৎসক। সেই সঙ্গে সমাজকর্মীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যেমন—লকডাউনকৃত অঞ্চলের বাসিন্দাদের বোঝানো, উদ্বুদ্ধ করা, সম্ভাব্য বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিকল্প (পরোক্ষ) সংযুক্তি স্থাপন, খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদা নিরূপণ ও তা নিয়মমাফিক সরবরাহ করা ইত্যাদি। একই সঙ্গে প্রয়োজন রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির মৌলিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা উপযুক্ত (মোবাইল) অ্যাপস ব্যবহার করে সবার মাঝে সংযুক্তি স্থাপন করে কার্যসম্পাদনে দক্ষতা আনা। একেকটি লকডাউনকৃত অঞ্চলের জন্য একটি সুসমন্বিত টিমের প্রয়োজন, যারা হবে সম্মুখভাগের লড়াকু। এদের সঙ্গে সম্মুখভাগে হাসপাতাল বা আইসোলেশন ক্যাম্পের চিকিৎসকরা আক্রান্তদের যেমন দেখভাল করবেন, তেমনি পশ্চাদ্ভাগে খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, প্রয়োজনীয় ওষুধ, কর্মীদের যানবাহন, (প্রয়োজনে) বসবাস ও বিশ্রামের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি বিভিন্ন উৎস থেকে অনুদান সংগ্রহকার্যে সমন্বয় সাধন করতে অনেক জনবলের প্রয়োজন।

আশা করব যে আয়োজনের ব্যাপকতা নেতৃত্ব দ্রুত উপলব্ধি করবেন এবং এসব আয়োজনে কোনো প্রকার দলীয় রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। একই সঙ্গে নিজ (দেশজ) শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। তা না করে বিদেশের পরামর্শে ঋণনির্ভর প্রকল্পের মাধ্যমে অগ্রজ তথ্যপ্রযুক্তির বা অপরীক্ষিত ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে সমাজ ও এ দেশের মানুষকে উন্মুক্ত করা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সে-জাতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের ধারা অব্যাহত থাকবে, যা নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং আত্মঘাতী পথে সমগ্র দেশকে ঠেলে দেবে।

ভিন্ন পরিসরে আমি আগেও বলেছি যে প্রতিটি সংকট নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করছি যে সম্ভাবনাময় সুযোগগুলো আমরা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং গতানুগতিক ধারায় আমরা বিদেশনির্ভর প্রকল্পের পথ বেছে নিচ্ছি। জাতির এ দুঃসময়ে প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ের সব শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে সমন্বিতভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বেগবান হওয়া। একেকটি লকডাউন অঞ্চলকে আনলক করাটাই হবে সে-জাতীয় ছোট ছোট লক্ষ্য।

এ পর্যায়ে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে গ্রামাঞ্চলে স্বঘোষিত লকডাউনের উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনেক গ্রামের বাসিন্দা বাইরে থেকে আসা নিজেদের সন্তানদের গ্রামের পরিসীমায় ঢুকতে দিচ্ছে না। গ্রাম্য পুলিশ তাদের ধরে থানায় হস্তান্তর করছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ-জাতীয় উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে প্রতিটি গ্রাম বা ইউনিয়নে পৃথক প্রাঙ্গণে (যেমন, বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আসাদের থাকা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিরীক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, তাদের পরিবারের সদস্যরা সেবাকর্মীদের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে আগ্রহী থাকবে এবং প্রাথমিক তথ্যপ্রযুক্তির (ক্যামেরা ও দূরে অবস্থিত মনিটর বা ফোনের স্ক্রিন) ব্যবহার শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক দূরত্ব লাঘবে ভূমিকা রাখবে।

পরিশেষে, বিস্তারিত ব্যাখ্যা না দিয়ে বলব, কঠোর নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে উৎপাদন কার্যক্রম ধীরে ধীরে শুরু করা সম্ভব। একইভাবে কৃষিপণ্য চলাচল ও বাজারজাত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা এবং নির্ঝঞ্ঝাট শহরগুলোয় ব্যাপক উন্নয়ন সাধনের এটাই উপযুক্ত সময়। সম্ভাব্য কার্য ও সেসব সম্পাদনের ধারা চিহ্নিত করা এবং সেগুলো সম্পাদনের উদ্যোগ নেয়া প্রগতিকামী নেতৃত্বের দায়িত্ব। কিন্তু সেজন্য রাজনৈতিক সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। বিগত দিনগুলোয় অনেকেই দিকনির্দেশনায় যে চরম অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন, তাদের দিয়ে জনগণের মনে আস্থা এনে করোনা-২ ভাইরাসের মতো অদৃশ্য শত্রুকে প্রতিহত করা অসম্ভবপ্রায়। এমনকি পদাধিকারবলে কমিটি বা টাস্কফোর্সের কার্যকারিতা সম্পর্কেও সন্দেহ রয়েছে। সেই সঙ্গে পুনরায় বলব যে স্থানীয় জ্ঞান ও সম্পদ ব্যবহার করে সামাজিক সংগঠনের নকুন জোয়ার সৃষ্টি করা হোক। বৈদেশিক ঋণ ও সমাজ বিচ্ছিন্ন পরামর্শকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অতি উন্নত প্রযুক্তি নির্ধারিত (যা এখনো পরীক্ষাধীন রয়েছে) ও চাপিয়ে দেয়া কর্ম সিদ্ধান্ত বিচ্যুতিহীনভাবে (তথাকথিত জিরো টলারেন্স) বাস্তবায়নের উদ্যোগ বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে।

না বললেই নয়, আমি সামাজিক দূরত্ব আনার স্লোগানের বিরোধিতা করি। আমাদের প্রয়োজন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি করা। তাই নির্বোধের মতো অনুকরণকারী না হয়ে মননে ও কর্মে সবাইকে সজীব হওয়ার আহ্বান জানাব।

এ দুর্দিনে সবার জন্য রইলো শুভ কামনা।

(নিবন্ধে উপস্থাপিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব, যার সঙ্গে ইআরজির সংশ্লিষ্টতা নেই)

ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক