অস্তিত্বহীনতার অস্তিত্ব: সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং কর

ড. সাজ্জাদ জহির |

আলোকপাত |
দৈনিক বণিক বার্তা |
অক্টোবর ২৪, ২০২২ |

 

দালানটি প্রায় ১০ বছর দাঁড়িয়ে আছে অভিজাত এলাকার একটি ব্যস্তময় রাস্তায়। এক-দুইতলা নয়, ১২ তলার দালান। আশপাশে তেমন কোনো উঁচু দালান না থাকায় এ দালানটিকে কোনোভাবেই চোখে হারানো সম্ভব নয়। খাটো দেয়ালঘেরা থাকায় রাস্তা থেকে উঁকি মারলেই ভেতরের সবুজ ঘাসঢাকা লনটি দেখা যায়। ফ্লোর-এরিয়া অনুপাত (এফএআর) ব্যবহার করে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে পেছনের ছয় তলাকে অদৃশ্য করে ১২তলা দালানটি প্রাথমিক অবয়ব পায় ২০১৩ সালের দিকে। বিল্ডারের অসহযোগিতার কারণে প্রতিটি মালিককে নিজ দায়িত্বে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরের ইটের গাঁথুনিতে বালি-সিমেন্টের প্রলেপ দিতে হয়, টাইলস-ফিটিংস, দরজা ও অন্যান্য ইনটেরিয়রের কাজ সারতে হয়। ২০১৬-১৭ নাগাদ দালানটিতে নানা কাজের মাঝে প্রথম পরিবারটি বসবাস শুরু করে এবং ২০১৮-তে প্রতিটি ফ্লোরে মালিক অথবা ভাড়াটে বসবাস শুরু করে।

দু-চারজন মালিকের সক্রিয় চেষ্টায় রাজউক থেকে ২০১৮-১৯ সালে প্রাথমিক ফ্ল্যাট বরাদ্দ চিঠি পেলেও সব অংশীদার এক হতে না পারায় বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে কারো কারো সন্দেহ জাগে যে বিল্ডার ফ্ল্যাটগুলো রেজিস্ট্রি করিয়ে দিতে আগ্রহী নয়। বিষয়টি আরো স্পষ্টতা পেল সিটি করপোরেশনে হোল্ডিং কর দেয়ার উদ্যোগ নিলে। ২০১৭-১৮ সালে বসবাস শুরু হওয়ার পর থেকেই অতিউৎসাহী দু-একজন মালিক রাজউকের রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই হোল্ডিং কর দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে, কিন্তু যতবারই তারা সিটি করপোরেশনের ব্যক্তি প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে, প্রতিবারই নানা অজুহাতে এ উদ্যোগ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ আসে। এক অদ্ভুত অযৌক্তিক যুক্তিচক্রের গোলকধাঁধায় প্রায় তিন-চার বছর সবকিছু দাঁড়িয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ও কর্মচারীদের দেয়াল পেরিয়ে নির্দিষ্ট কর-নিরূপক কর্মকর্তার সঙ্গে স্বল্পসংখ্যক উদ্যোগীর যোগাযোগ হয়। কয়েকদিনের মাঝে থলের বিড়াল এমনভাবে বেরিয়ে আসে যে সবাই হতবাক।

প্রথমে জানা গেল, ওই ১২ তলা দালানের অস্তিত্ব সিটি করপোরেশনের নথিতে নেই। আদি রাজউক প্লটের পেছনের অংশে যে ছয়তলা দালান ২০-২২ বছর আগে তৈরি হয়েছিল সেটাকেই পুরো প্লটজুড়ে দেখানো আছে। অথচ প্লট বিভাজন হয়ে সামনের অংশে ১২ তলা তৈরির রাজউকের অনুমতি প্রায় ১০-১২ বছর আগে হয়েছে, মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশনের (লোক দেখানো?) নোটিস এসেছিল ১২ তলার বাসিন্দাদের কাছে এবং বিল্ডার ও তার স্বার্থরক্ষাকারী মধ্যস্বত্বভোগীরা নিবন্ধীকরণের আশ্বাস দিয়ে আসছিল।

দ্বিতীয় সত্যের উদঘাটন আমার বন্ধুর জন্য ছিল আরো হূদয়বিদারক। মালিক পক্ষের অনেকে দীর্ঘদিন এ অস্তিত্বহীনতা মেনে আরো কিছু সময় অতিবাহিত করতে আগ্রহী ছিল, অর্থাৎ তারা নথিভুক্ত হতে চায়নি। এর একমাত্র ব্যাখ্যা মেলে কাগজের অসংলগ্নতা রেখে সবাই সম্ভবত সম্পত্তি বিক্রি করে অপ্রদর্শিত আয়কে অপ্রদর্শিত রেখে দিতে চেয়েছিল!

তৃতীয় বিষয়টি রাজস্ব-পিপাসু সরকারকে ভাবা প্রয়োজন। মাত্র একটি দালান থেকে প্রতি বছর ৫-৮ লাখ টাকা হোল্ডিং কর পাওয়ার কথা। অথচ তা আদায় হচ্ছে না। ভেতর থেকে যারা দালানটির অস্তিত্বহীনতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে, তাদের স্বার্থ এখানে গৌণ বা পরোক্ষভাবে অর্জিত। প্রাথমিক মালিক পক্ষের (ক্ষুদ্র বা বৃহৎ) স্বার্থ এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। অর্থের বিনিময়ে সেসব অদৃশ্য মালিক এ অস্তিত্বহীনতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট। এছাড়া যাদের কাছে ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি হবে, সেসব নতুন মালিকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের সুযোগ রয়েই যাবে।

কথা না বাড়িয়ে সম্পত্তির/ফ্ল্যাটের বাজারে ঠগবাজদের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং সিটি করপোরেশনের রাজস্ব নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি পরামর্শ রইল।

১। নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিলমোহর দিয়ে কাগজ বা নকল নথি তৈরির প্রচলন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এবং সম্পত্তি কেনাবেচায় সম্ভবত এটা সর্বাধিক। তাই মালিকানার কাগজ যাচাই করা জরুরি। বিশেষত, যৌথ অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি থাকা আবশ্যিক।

২। ব্যক্তি-ক্রেতা হিসেবে দালাল-চক্রের খপ্পর থেকে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষার প্রাথমিক উপায় হলো, সরাসরি অন্যান্য (সম্ভাব্য) মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করা।

৩। একটি সম্পত্তির মালিক হিসেবে নিজেকে গণ্য করার আগে যাচাই করে দেখা প্রয়োজন যে ওই সম্পত্তিটি বিক্রি করার জন্য আমার কাছে সব কাগজ আছে কিনা।

নীতি পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে রাজউক, দলিল ও ভূমি নিবন্ধীকরণ দপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।

৪। রাজউকের কারিগরি দপ্তর থেকে দালান নির্মাণের অনুমোদন দেয়া মাত্রই তার একটি কপি সিটি করপোরেশনের কাছে যাওয়া বাধ্যতামূলক করলে অস্তিত্বহীন থাকার সুযোগ থেকে ঠগবাজদের বঞ্চিত করা যায়। সেই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের করনির্ধারণী কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতায় আনা সম্ভব।

৫। রাজউকের কারিগরি শাখা প্রদত্ত অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট ছাড়াই যখন অধিকাংশ দালানে মানুষ বসবাসরত আছে এবং তারা সেবা নেয়া শুরু করেছে, তাদের রাজস্ব দেয়া নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত আইনি পরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিধিতে সংস্কার আনা প্রয়োজন।

৬। দশজনে মিলে একটি প্লট কিনে কিছু উন্নয়ন সাধন করে অসমাপ্ত অবস্থায় তা লাভে বিক্রি করাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে ব্যাংকঋণের বা সরকারি অনুমোদনপত্র বা করের দায় অন্যের কাঁধে (অনুল্লেখিত রেখে) চাপিয়ে দেয়া অপরাধ, যা সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য, আইনত দণ্ডনীয় করা জরুরি।

৭। বন্ধুর কাছ থেকে প্রাথমিক উপাদান পাওয়ার পর ব্যক্তি-অনুসন্ধানে জানতে চেয়েছিলাম কেন ভাড়া দেয়া ও নিজে থাকা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য বিশাল ফারাকের (১০:৬) হোল্ডিং কর ধার্য করা হয়। কোনো সদুত্তর পাইনি বরং জেনেছি এদেশের আইন প্রণয়নে ক্ষুদ্র ক্ষমতাধর গোষ্ঠী (যেমন—ডেভেলপার, ঋণদানকারী সংস্থা) এবং নির্দিষ্ট রেগুলেটরি/বাস্তবায়ন সংস্থার স্বার্থই প্রাধান্য পায়। যাদের অর্থে এ বাজারটি সচল থাকে তারা অবহেলিত এবং যারা ফটকা লাভের জন্য এ বাজারে অল্প সময়ের জন্য অংশগ্রহণ করে অধিক মুনাফা নিয়ে বেরিয়ে যায়, তারা বাজারের শৃঙ্খলাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এ গল্প জানার পর মনে হলো, সরকারের মাঝে রাজস্ব আদায়ের তাগিদ হয়তো নেই। দুই মাস আগে ট্যাক্স-রিটার্নের সঙ্গে পাওনা কর মেটাতে যে চেক জমা দিয়েছিলাম তা নগদ (ক্যাশ) করা হয়েছে কিনা ব্যাংকের কাছে জানতে চাই। আজ অবধি কর কর্তৃপক্ষ টাকাগুলো নেয়নি জেনে অবাক হলাম। আসলেই কি সরকারের টাকার চাহিদা নেই! নাকি সরকার ও সরকার-প্রতিনিধি দুটি ভিন্ন সত্তা, যা গুনতিতে এনে নীতি প্রণয়ন জরুরি। সে গঠনমূলক সমালোচনা নিয়ে যে অর্থনীতিবিদ বা গবেষক এগিয়ে আসতে চাইবেন, অবাক হলাম জেনে যে নতুন ডিজিটাল ব্যবস্থায় (যেমন, ই-পাসপোর্টে) তাদের অস্তিত্বের সুযোগ রাখা হয়নি!

ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ

sajjadzohir@gmail.com

Download Document

Source: https://bonikbarta.net/home/news_description/317840/%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC:-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%BF%E0%A6%82-%E0%A6%95%E0%A6%B0-


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *